অবৈধ মাটি কাটা ও ইটভাটার দৌরাত্ম্য কৃষি উৎপাদনে হুমকি

অবৈধ মাটি কাটা ও ইটভাটার দৌরাত্ম্য কৃষি উৎপাদনে হুমকি

উপজেলা সংবাদ ফরিদগঞ্জ উপজেলা মতলব দক্ষিণ উপজেলা শাহরাস্তি উপজেলা সদর উপজেলা স্লাইড

অবৈধ মাটি কাটা ও ইটভাটার দৌরাত্ম্য কৃষি উৎপাদনে হুমকি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবৈধ মাটি কাটা ও ইটভাটার দৌরাত্ম্য কৃষি উৎপাদনে হুমকি

নদী পরিবেষ্টিত চাঁদপুর জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি ও মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু দিন দিন কৃষি জমি সংকুচিত হয়ে পড়ছে, যার পেছনে রয়েছে অবৈধ মাটি কাটা,

ইটভাটার প্রসার এবং অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ। বিশেষজ্ঞদের মতে,

এভাবে চলতে থাকলে খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।

ইটভাটার প্রসার : মাটির জন্য ধ্বংস কৃষি জমি

জেলার ৮টি উপজেলার প্রায় ৯৮ হাজার হেক্টর জমি ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জন্য চাষাবাদযোগ্য। কিন্তু সেই জমিগুলোর অনেক জায়গায় ইটভাটা গড়ে উঠেছে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই অবৈধ। বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে ইট তৈরির

কাঁচামাল হিসেবে ফসলি জমির ওপরি অংশের উর্বর মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।সরেজমিন ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলায় দেখা গেছে,

আগে অনুর্বর ও অনাবাদি জমির মাটি ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে সরাসরি ফসলি জমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে সংঘবদ্ধ চক্র।

ভাটা মালিকদের সহযোগিতায় তারা কৃষকদের জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করছে, যা কৃষি উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

কৃষি জমি নষ্ট করার নেপথ্যের কারণ

ইটভাটায় ব্যবহৃত মাটির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে অনেকেই ফসলি জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করছেন।

ফরিদগঞ্জ উপজেলার মানিকরাজ এলাকার একটি ইটভাটার পরিচালক মিরন খান বলেন, “ইট তৈরির জন্য জমির মাটি ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই।

বাধ্য হয়েই আমরা এ মাটি সংগ্রহ করছি।” তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, এটি বৈধ নয়।

অন্যদিকে, শাহরাস্তি উপজেলার একটি সেচ ব্যবস্থাপকের মতে, “জমির কিছু অংশ উঁচু-নিচু হওয়ায় গত দুই বছর ধরে ফসলি জমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে।

এটি বন্ধ করার জন্য ভবিষ্যতে পদক্ষেপ নেয়া হবে।”

কৃষকদের সংকট ও অভিযোগ

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা বলছেন, জমির ওপরি স্তরের উর্বর মাটি কেটে নেয়ায় জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।

একইসঙ্গে মাটি পরিবহনের জন্য তৈরি রাস্তা ও স্থাপনার কারণে জমির আরও ক্ষতি হচ্ছে।

এক কৃষকের অভিযোগ, “জমি থেকে মাটি কেটে নেয়ায় আমাদের জমি এখন অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে। ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে, সংঘবদ্ধ চক্র এসব মাটি বিক্রি করে তাদের ব্যক্তিগত লাভ করছে।”

পুকুর খননের নামে মাটি কাটা

সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নে দেখা গেছে, ১০ একর জমি কেটে দীঘি তৈরি করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কিছু ব্যক্তি মসজিদ-মাদ্রাসার

উন্নয়নের অজুহাত দেখিয়ে এই কাজ করছেন। এতে পাশের জমির মালিকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব বিষয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একজন জানিয়েছেন, “আমরা দীঘি তৈরি করছি মসজিদ ও মাদ্রাসার উন্নয়নের জন্য। তবে প্রশাসনের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন ছিল, সেটি আমরা করিনি।”

কৃষি জমি হারানোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, “জমির ওপরের ৬ ইঞ্চি মাটি সবচেয়ে বেশি উর্বর।

এই মাটি কেটে নেয়া হলে জমি পুনরায় উৎপাদনক্ষম হতে ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। এমনকি তখনও জমি আগের মতো উর্বর থাকে না।”

তিনি আরও বলেন, “এই সমস্যা সমাধানে মাটি কাটার বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।”

প্রশাসনের ভূমিকায় সীমাবদ্ধতা

শাহরাস্তি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইয়াসির আরাফাত বলেন, “আমরা মাটি কাটার বিষয়ে অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই।

তবে প্রশাসনিক কাজের ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় সঠিক সময়ে অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। তবুও অভিযান অব্যাহত আছে।”

চাঁদপুর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আল-ইমরান খাঁন বলেন, “কৃষি জমি ভরাট কিংবা শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য অনুমোদন নিতে হয়।

জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া কোনো জমির শ্রেণি পরিবর্তন বা মাটি কাটার কাজ বৈধ নয়।”

সমাধানের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

জেলার কৃষি জমি রক্ষায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর আইন প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এ সংকট নিরসন সম্ভব নয়।

জমির উর্বরতা নষ্ট হওয়া বন্ধ করতে স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা ও সরকারি তদারকির ওপর জোর দিতে হবে।

এভাবে চলতে থাকলে শুধু চাঁদপুর নয়, পুরো অঞ্চলের খাদ্য উৎপাদনই বড় ধরনের সংকটে পড়বে। কৃষি ও পরিবেশের সুরক্ষার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

Daily Chandpur Sangbad

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *